Short Story for Kids (রূপকথার গল্প)
Best rupkothar golpo jegulo apnader valo lagbe. Niche Deya holo

1. কচ্ছপ ও বানর

বানর রাজার নাম হলো ‘কারদানা’। এই বানররাজ ছিল খুবই ন্যায়নীতিবান তবে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, যাকে বলে একেবারে থুরথুরে বুড়ো। জীবন গাছের সবুজ পাতাগুলো তার ঝরে পড়তে পড়তে শরতের রূপ ধারণ করেছে। শরত মানেই পাতা ঝরার কাল। যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যের কাল। কারদানা রাজার অবস্থা এখন তেমনি থুরথুরে শারদী। না আছে তার যৌবন আর না আছে সেই সতেজতা...তারুণ্যের সেই উচ্ছ্বল সোনাঝরা দিনগুলো হারিয়ে গেছে...। এই বুড়ো বানর রাজার রাজ্যে ছিল তরুণ এক বানর। সে সবসময় স্বপ্ন দেখতো রাজা হবার। সারাক্ষণ সে সুযোগের সন্ধানে থাকতো তার স্বপ্ন পূরণ করার, স্বপ্নকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করার। তার মাথা থেকে এই স্বপ্ন কোনোভাবেই যেত না বরং ক্রমশ আরো রঙীন হয়ে উঠত।

কিন্তু বৃদ্ধ বানর রাজাটাও মরে না, তারও ভাগ্য খোলে না। কতো আর অপেক্ষা করা যায়! তরুণ বানরের প্রতীক্ষার প্রহর যেন আর কাটতে চায় না। সে একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছে। এদিকে সময়ও যেন তার জন্যে নষ্ট ঘড়ির কাঁটার মতো অচল হয়ে আছে। সে মনে মনে ভাবল: বানর রাজার তো আর প্রশাসন চালানোর মতো শক্তি সামর্থ নেই বললেই চলে। কী আর হবে! এই ভেবে সে তার কয়েকজন সঙ্গী সাথীকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। তাদেরকে নিয়ে একদিন সে বৃদ্ধ এবং দুর্বল রাজা কারদানার ওপর আক্রমণ করে বসে।

কারদানার তো আর এই আক্রমণ প্রতিহত করা কিংবা মোকাবেলা করার মতো শক্তি সামর্থ ছিল না। সুতরাং পরাজয় বরণ করে নিল। রাজার পরাজয় মেনে নেওয়া মানে ষড়যন্ত্রকারী তরুণ বানরকেই রাজা বানানো। তাই হলো। আক্রমণকারী তরুণ বানর রাজা বনে গেল। কিন্তু তরুণ রাজা বৃদ্ধ কারদানাকে বাদশাহীর মসনদ থেকে সরিয়েই তৃপ্ত হলো না, তাকে মেরে ফেলতেও উদ্যত হলো। কারদানা তাকে মারার বিষয়টি টের পেয়ে পালিয়ে গেল। সমুদ্র উপকূলীয় একটি জঙ্গলের ভেতর চলে গেলে কারদানা। ওই তরুবীথিটি ছিল ফলমূলে ভর্তি। সেসব খেয়েই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছে কারদানা। একাকী সেই বনে এভাবেই কাটতে লাগল তার দিনরাত্রি। একদিন গাছের ডালে বসে ডুমুর খাচ্ছিলো সে। হঠাৎ একটা ডুমুর তার হাত থেকে নিচে পানিতে পড়ে গেল। সেখানে গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিল একটা কচ্ছপ। কচ্ছপ ডুমুরটা দেখতে পেল এবং পানিতে গিয়ে ডুমুরটা এনে খেয়ে ফেলল। ডুমুরটা বেশ মজাই লাগলো তার কাছে।

ডুমুর পানিতে ফেলার শব্দ কারদানা খুব ভালো লাগল। সেজন্যে সে একটা ডুমুর খায় তো আরেকটা পানিতে ফেলে। ওদিকে কচ্ছপও মজা পেয়ে একটা খেয়ে অপেক্ষায় থাকে আবার কখন পড়ে। যে তার জন্যে এভাবে ডুমুর ফেলছে সেই মহান এবং উদার প্রাণীর জন্যে তার খুব মায়া হলো। সে গাছের নিচে বসেই চিৎকার করে বলল: হে আমার অদেখা নতুন বন্ধু! তোমার দয়ার অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। যে ফলগুলো তুমি আমার জন্যে ফেলেছো, খুবই সুস্বাদু এবং মজার।

কচ্ছপের চিৎকার শুনে বুড়ো বানর নিচের দিকে তাকায়। কচ্ছপ তার নজরে পড়ে। তাকে সালাম জানিয়ে বানর বলে: হে প্রিয় নতুন বন্ধু আমার! তোমাকে এখানে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি। একাকী জান বের হয়ে যাচ্ছিল আমার। তোমার অস্তিত্ব আমার জন্যে বিশাল প্রাপ্তি। আমি এক্ষুণি নিচে এসে পরস্পরে পরিচিত হব। তাই হলো। কচ্ছপ বলল: আচ্ছা! তুমি কোত্থেকে এসেছো? কোথায় যাবে? এখানে কী করছো?
কারদানা তার জীবনের সত্য গল্প খুলে বলল। এরপর বলল ‘ব্যস, এখন এভাবেই তোমার খেদমতে আছি। কী যে ভালো হলো তোমাকে পেয়ে...নিঃসঙ্গতায় দমি একেবারে আটকে যাচ্ছিল আমার’।
কচ্ছপও বলল: ‘আমিও তোমাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। আশা করি তুমি আমি ভালো বন্ধুই হবো’।

এরপর ভালোভাবেই তাদের কেটে গেল বহুদিন। তাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হলো। কচ্ছপের তো বউ-বাচ্চা ছিল। নতুন বন্ধুর টানে তাদের প্রতি টানে ভাটা পড়ল কিছুটা। ব্যাপারটা কচ্ছপের স্ত্রী টের পেল এবং কিছুটা বিরক্তও হলো। তার ঘুম চলে গেল দু’চোখ থেকে। কেন যে তার স্বামি বাসায় ফিরছে না বুঝে আসছিল না তার। তবু পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো কচ্ছপের স্ত্রী। তাকিয়ে থাকতে থাকতে একদিন তার চোখে পড়ল তার এক প্রতিবেশিকে। প্রতিবেশি তাকে বিষন্ন দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল: কী হয়েছে, এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
আগন্তুককে সে বলল: মনের জ্বালা আর বাড়িও না বোন। কী আর বলব, না বলাই বরং ভালো! আমার স্বামী আর কদিন হলো বেরিয়েছে, এখনো ফেরার কোনো লক্ষণ দেখি না।
প্রতিবেশি বলল: চিন্তা করো না, আমি জানি, কোথায় আছে তোমার স্বামী।
কচ্ছপের বউ বলল: তাই নাকি, কোথায়, কোথায় বলো না!
প্রতিবেশি কচ্ছপ বলল: দু'তিনদিন আগে আমি সমুদ্র তীরের জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম সে একটা বানরের সাথে গল্প করছে। মনে হলো নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে, সেজন্যেই হয়তো.....
কথা শেষ না হতেই কচ্ছপের স্ত্রী বলল: তার মানে নিজের বউ-বাচ্চার চেয়েও নতুন বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল!..এই বলেই কাঁদতে শুরু করে দিলো..
প্রতিবেশির স্ত্রী বলল: না কেঁদে বরং উপায় খুঁজে বের করা উত্তম।
কচ্ছপের স্ত্রী বলল: কী করব..কিছুই তো মাথায় খেলছে না..
প্রতিবেশি কচ্ছপ বলল: বানরকে মেরে ফেলাই একমাত্র সমাধান। এক কাজ করো, তুমি অসুস্থতার ভান করো, বাকি কাজ আমি করছি... তুমি শুধু একটা কাজ করবে, যখন তোমার স্বামী ফিরে আসবে..তুমি কান্নাকাটি শুরু করবে..।

এই বলে সে চলে গেল বানরের বন্ধু কচ্ছপের কাছে। কচ্ছপ তো প্রতিবেশিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। এখানে কী জন্যে, জিজ্ঞেস করতেই প্রতিবেশি অনুযোগের স্বরে বলল: ক'দিন হলো বাসা থেকে বের হয়েছো? খবর আছে তোমার বউ বাচ্চার! কী হালে আছে.. মরে গেছে না বেঁচে আছে?
কচ্ছপ বলল: তাই তো! আমি তো ভুলেই গেছিলাম। কেন, কোনো সমস্যা হয় নি তো!
প্রতিবেশি কচ্ছপ বলল: বেশ কদিন ধরে তোমার বউ অসুস্থ..খালি তোমাকে ডাকছে..

কচ্ছপ তার বউয়ের অসুস্থতার কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি বন্ধু বানরকে বলল: দোস্ত! মাফ কর! তোমাকে একা রেখে আমাকে একটু বাসায় যেতে হচ্ছে। কথা দিচ্ছি আবারো ফিরে আসব। খোদা হাফেজ!
বানর কচ্ছপকে বলল: তোমার বউয়ের অসুস্থতার কথা শুনে সত্যিই খারাপ লাগলো। আমি যদি কোনো হেল্প্ করতে পারতাম ভালো লাগত।
ঠিক আছে! এই বলে ধন্যবাদ জানিয়ে কচ্ছপ ফিরে গেল বাসায়।


2. ঘাসের পুতুল 

অনেক অনেক দিন আগের কথা। নরওয়ে দেশে এক রাজা ছিল। আর সেই রাজার ছিল এক-এক করে বারোটি ছেলে। রাজপুত্ররা দেখতে-দেখতে একদিন বড় হয়ে গেল। রাজা রাজপুত্রদের ডাকল। বলল, তোমরা এখন বড় হয়েছে। যাও, এখ তোমরা বউয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়। রাজার কথা শুনে রাজপুত্রেরা ভারি খুশি হল। তারা লাল টুকটুকে বউই নিয়ে আসবে। রাজা বলল, দেখ, যে কোনও মেয়েকে আবার বিয়ে করে বসো না যেন। যে মেয়ে সুতা কাটতে পারে, কাপড় বুনতে পারে, একদিনেই জামা সেলাই করতে পারে সেরকম মেয়েকেই বিয়ে কোরো কিন্তু। এই বলে রাজা রাজপুত্রদের ঘোড়া আর ঢাল-তলোয়ার দিলেন। রাজপুত্ররা ঢাল-তলোয়ার নিয়ে মনের আনন্দে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কিছু দূর যাওয়ার পর রাজপুত্ররা ঘোড়া থামাল। রাজপুত্রদের মধ্যে সবচে ছোট যে রাজপুত্রের তার নাম ছিল বুটস। বুটসকে অন্য রাজপুত্ররা দারুণ হিংসে করত। তারা বুটস কে সঙ্গে নেবে না। বুটস কোনও কাজের না। তারা বুটস কে পথের মাঝখানে ফেলে রেখে আবার ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বুটস মনের দুঃখে ঘোড়া থেকে নামল। এখন কোথায় যাই, কি করি। এমন সব ভাবতে লাগল সে। বউ নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে না -গেলে রাজা আবার রাগ করবে। কিন্তু আমি এখন বউ পাই কোথায়? বুটস বসে বসে কাঁদতে লাগল। ওর চারপাশে ঘাসের বন। সোনালি রোদে ডুবে আছে। ঘাসের লম্বা ডগাগুলি দুলছিল বাতাসে । হঠাৎ বুটস দেখতে পেল যে ওর পায়ের কাছে ঘাসগুলি নড়ছে। ওখানে ছোট সাদা একটা কি যেন।ওমাঃ, ছোট্ট একটা মেয়ে যে! অনেক ছোট্ট। বুটস ঝুঁকে দেখল: ঘাস দিয়ে তৈরি একটা ছোট পুতুল। চমৎকার একটা চেয়ারে বসে আছে। আহা, কী সুন্দর দেখতে! ঘাসের পুতুল কে বুটস- এর ভারি পছন্দ হয়ে গেল। ঘাসের পুতুল রিনরিনে কন্ঠে বলল, তুমি কে গো? এখানে কি করছ শুনি? বুটস তখন ঘাসের পুতুলকে সব খুলে বলল। ওর দুষ্টু ভাইদের কথা বলল, রাজার কথাও বলল। ও যে বউয়ের খোঁজে বেরিয়েছে সে কথাও বলল। বলল, যে কোনও মেয়ে হলে চলবে না কিন্তু। যে মেয়ে সুতা কাটতে পারে, কাপড় বুনতে পারে আর একদিনেই জামা সেলাই করতে পারে- সেরকম মেয়েকেই বিয়ে করবে বুটস। ঘাসের পুতুল মন দিয়ে বুটসের কথা শুনল। তারও যে বুটসকে ভারি পছন্দ হয়েছে। তা ছাড়া ঘাসের পুতুল সুতা কাটতে পারে, কাপড় বুনতে পারে একদিনেই জামা সেলাই করতে পারে। তবে সে জামা ছোট। অনেক ছোট। বুটসকে সে কথা ঘাসের পুতুল বলল। বুটস বলল, তালে আমি তোমাকে বিয়ে করব। তুমি দেখতে খুব সুন্দর। ঘাসের পুতুল লজ্জ্বা পেলেও রাজি হল । বুটসও খুশি হল । আবার লজ্জ্বাও পেল। ঘাসের পুতুল এত ছোট! রাজা একে দেখে কি মনে করেন। বুটস বলল, তা'লে এখন তুমি আমার ঘোড়ার পিঠে চড়ে বস। ঘাসের পুতুল বলল, কেন? আমি তোমার ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসব কেন? বুটস বলল, বারে। তুমি রাজপ্রাসাদে যাবে না? কেন- তুমিই না তখন আমায় বললে যে তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও। না। আমি ঘোড়ায় চড়ব না। ঘাসের পুতুল ঘাড় বাঁকিয়ে বলল। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। তালে? তালে তুমি কীভাবে রাজপ্রাসাদে যাবে? বলে অবাক হয়ে ঘাসের পুতুলের দিকে তাকিয়ে রইল বুটস। ঘাসের পুতুল বলল, আমি যাব রূপোর চামচে করে । আমার ছোট-ছোট দুটি সাদা ঘোড়া আছে। ঠিক আছে। তাই চল। বুটস বলল। বুটস ঘোড়ায় আর ঘাসের পুতুল দুটি ছোট ছোট ঘোড়ায় টানা রূপোর চামচে যেতে লাগল। অবশ্যি ঘাসের পুতুল যাকে সাদা ঘোড়া বলছে, সেগুলি আসলে ছোট ছোট দুটি ইঁদুর! যা হোক। বুটস রাস্তার ধার ঘেঁষে চলতে লাগল। কারণ, ঘাসের পুতুল এত ছোট । যদি তার ওপরে ধপাস করে পড়ে যায়! তারপর যেতে-যেতে যেতে-যেতে পড়ল একটা নদী। বুটসের ঘোড়া নদীর পাড়ে এসে নদীর পানি দেখে পেল ভয়। ঘোড়াটা পথ আটকে চিহি চিহি করতে লাগল। আর তাতে হল কী জান - ঘাসের পুতুল নদীর পানিতে পড়ে গেল ... আর হাবুডুবু খেতে লাগল । বুটস-এর কান্না পেল। সে কী করতে বুঝতে পারল না। সেই নদীতে ছিল একটা যাদুকর মৎস্যপুরুষ (Merman) সেই যাদুকর মৎস্যপুরুষই নদীর পানি থেকে ঘাসের পুতুলকে তুলে এনে দিল পাড়ে ... আর কী আশ্চর্য! ঘাসের পুতুল আর ছোটটি নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে। প্রায় বুটসের সমান। আর কী সুন্দরই-না দেখাচ্ছে ওকে। যেন নরওয়ে দেশের লাল টুকটুকে রাজকন্য। বুটস খুশিতে আটখানা হয়ে রূপসী ঘাসের পুতুলকে ঘোড়ায় তুলে নিল। রাজপ্রাসাদের ফিরে বুটস দেখল ওর অন্য সব ভাইয়েরাও বউদের নিয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু ভাইয়ের বউগুলি দেখতে ভারি কুশ্রী। তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে ঝগড়া করছে। তাদের মাথায় নোংরা টুপি। সেই টুপিতে ঝুল আর আলকাতরা লেগে আছে। বৃষ্টির পানিতে ওদের মুখগুলি নোংরা হয়ে আছে। ভারি কুশ্রী আর কুৎসিত দেখাচ্ছিল ওদের । ভাইয়েরা বুটস আর ঘাসের পুতুলকে দেখে ঈর্ষায় জ্বলে উঠল। রাজা কিন্তু বুটস আর ঘাসের পুতুলকে দেখে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলেন। রাজা অন্য ছেলেদের আর তাদের বউদের রাজপ্রাসাদ থেকে বার করে দিলেন। তারপর বুটস-এর সঙ্গে ঘাসের পুতুলের বিয়ে দিলেন। বিয়ের দিনে নানা রকম উপহার নিয়ে ভোজসভায় রাজ্যের লোকজন এল। তারপর? তারপর বুটস আর ঘাসের পুতুলের দিনগুলি বড় সুখে কাটতে লাগল। অনেক অনেক সুখে। ... যদি আজও তারা বেঁচে থাকে তো আজও তারা সুখেই আছে ...



3. জিরাফ কীভাবে লম্বা গলা পেল

অনেক অনেক দিন আগে আফ্রিকা মহাদেশে জিরাফদের গলা ছিল খুবই ছোট। এতই ছোট যে মানুষের গলা থেকেও এক ইঞ্চির মত ছোট ছিল। জিরাফেরা এটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করতো। কিন্তু একটা ঘটনার পরেই জিরাফের গলা লম্বা হয়ে গেল।

গ্রীষ্মের এর দুপুরে কিছু জিরাফ পরিবার একসাথে পিকনিকে গেল। সব বাচ্চা জিরাফেরা খেলা ধুলা করছিল আর বড়রা গল্প করছিল। টিম নামে এক ছোট্ট জিরাফ তার মামাতো ভাই বোন টিনা আর মারগারেট এর সাথে বল নিয়ে খেলা করছিল। তারা একজনের মাথার উপর দিয়ে বল ছুঁড়ে খেলা করছিল। কাছেই একটা দুষ্টু জিরাফ খেলা করছিল। তার নাম এল্ভিন।  টিম, টিনা আর মারগারেটের খেলা দেখে এল্ভিনের মাথায় হঠাত একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসলো। কিছুক্ষণ খেলার পরে তিনজন বিশ্রাম নেয়ার জন্যে পাশেই একজায়গায় বসে গল্প করতে লাগলো। ঠিক তখনই এল্ভিন চেঁচিয়ে বলে উঠল “দেখো দেখো তোমাদের বল নেই!” সবাই তাকিয়ে দেখলো তাদের বল এল্ভিন উপরে ছুঁড়ে গাছের উঁচু ডালে আটকে ফেলেছে। ছোট্ট টিম তার বলের এই অবস্থা দেখে কাঁদতে শুরু করলো। কান্না থামিয়ে সে হঠাত বলল, “টিনা তুমি আমাকে উঁচু করো তাহলে আমি গাছ থেকে বল নামিয়ে আনতে পারবো।” এরপরে টিম টিনার উপরে ভর করে গাছ থেকে বল পারার চেষ্টা করল কিন্তু বলের নাগাল পেতে আরো একটু উঁচু হওয়া দরকার ছিল। টিম মারগারেটকেও বলল টিনাকে উঁচু করতে। মারগারেট ও তাদের নিচ থেকে উঁচু করে ধরলে টিম বলের নাগাল পেল। কিন্তু হঠাত করেই মারগারেটের পা পিছলে গেল অমনি মারগারেটের উপরে থাকা টিনাও পড়ে গেলো, টিমের হাতের ধাক্কায় বলও গাছ থেকে পড়ে গেলেও টিম এর গলা গাছের দুই ডালের মধ্যে আটকে গেলো। ছোট্ট টিম গাছের দুই ডালের মধ্যে আটকে ঝুলতে থাকলো। টিনা আর মারগারেট বাকি জিরাফদের ডেকে আনলো, এবার সবাই মিলে টিমের পা ধরে টেনে নামাতে চেষ্টা করলো। উপস্থিত সব জিরাফ অনেক টানা টানা করার পরে টিমকে গাছের ডাল থেকে নামাতে পারলো কিন্তু সবাই আশ্চর্য হয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলো। সবাই দেখলো যে টানাটানিতে টিমের গলা অনেক লম্বা হয়ে গেছে।

কিন্তু সবাই আবিষ্কার করলো যে গলা লম্বা হওয়ার কারনে টিম অনেক সুবিধা পাচ্ছে, সে গাছ থেকে অনেক সহজেই খেতে পারছে, এমনকি গাছের উঁচু ডল থেকে পাতা খেতেও তাকে লাফ দিতে হয় না আর টিমও তার লম্বা গলা দিয়ে উঁচু থেকে আফ্রিকার অনেক দূরের দৃশ্য দেখতে পেত। এরপরে সবাই এই সুবিধা পেতে উঁচু গাছের সাথে গলা ঝুলিয়ে টেনে গলা লম্বা করে ফেলল। ব্যাস এরপর থেকেই জিরাফের গলা হয়ে গেলো সবার থেকে লম্বা।

4. ডুমুর বুড়ো 

গালীল প্রদেশটি ছিল প্রাচীন ফিলিস্তিনে। প্রাচীনকালে সে প্রদেশে এক বুড়ো বাস করত। বেশ থুরথুরে বুড়ো। একশর কাছাকাছি বয়স। তারপরও রোজ বাগানে পরিশ্রম করত বুড়ো। কষ্ট হত। পরিশ্রম হত। তবুও করত। একবার। বুড়োর একটা ডুমুর গাছ লাগাতে ইচ্ছে হল। ভাবল, মহামহিম ঈশ্বরের ইচ্ছে হলে একদিন আমি এ গাছের ফল খেয়ে মরতে পারব।
প্রাচীন ফিলিস্তিনে তৎকালে রোমান শাসন বলবৎ ছিল। রোমান তখতে আসীন সম্রাট হাদ্রিয়ান । সম্রাট হাদ্রিয়ান দোদন্ড প্রতাপশালী সম্রাট হলেও রোমান সম্রাটদের মধ্যে শিল্পসংস্কৃতিমনা হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল।

সম্রাট হাদ্রিয়াদের রাজত্বকাল ১১৭ থেকে ১৩৮ শতক।

তো, রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ান সসৈন্য গালীল প্রদেশ পরিভ্রমন করছিলেন। একটা বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বাগান ঘেরা সাদা রং করা অনুচ্চ কাঠের বেষ্টনী। বেষ্টনী ঘেঁষে জলপাই গাছ। বুনো গোলাপের ঝাড়।
সেই বাগানেই ডুমুর গাছ লাগাচ্ছিল বুড়ো ...
দৃশ্যটায় কী গভীর মমতা ছিল। প্রাণময়তা ছিল । চোখে পড়ে যেতেই ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন সম্রাট। কৌতূহলী সম্রাট বুড়োকে ডেকে আনার জন্য একজন সৈন্যকে নির্দেশ দিলেন।
বুড়ো সম্রাটের কাছে এল। ঝুঁকে সম্রাটকে অভিবাদন করল ।
সম্রাট বললেন, বাগান কার?
আমার জাঁহাপনা। কপালের ঘাম মুছে বলল বুড়ো। তামাটে কপালে অসংখ্য বলিরেখা। ভ্রুঁ দুটি পাকা। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে।
সম্রাট হেসে বললেন, এই বয়েসে গাছ লাগিয়ে কী লাভ? ফল কি খেতে পারবেন?
বুড়ো খনখনে গলায় বলল, খোদার ইচ্ছে হলে ঠিকই পারব। আপনি-আমি তো তারই ইচ্ছা।
সম্রাট হাদ্রিয়ান পৌত্তলিক হলেও জীবনে অসংখ্যবার অদৃশ সত্তার উপস্থিতি টের পেয়েছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিগ্যেস করলেন, তা বয়স কত হল আপনার ?
এ বছর একশ বছরে পা দিলাম জাঁহাপনা। বুড়ো বলল।
হুমম। একশ বছর। তারপরও ফল খাওয়ার আশা? সম্রাটের মুখে হাসি। চোখে কৌতূকের ঝিলিক।
বুড়ো বলল, আমি খেতে না-পারলে আমার ছেলে খাবে ।ওই বাগান তো আমার পিতা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। বলে হাত তুলে বাগান দেখাল বুড়ো। ঝলমলে রোদে জলপাই গাছের পাতারা কাঁপছিল বাতাসে।
ঠিক আছে। আপনি যেন ফল খেতে পারেন আমি এই প্রার্থনা করি। আর তেমনটি হলে আমাকে জানাবেন।
বলে সম্রাট আবার ঘোড়া ছোটালেন।

দশ বছর অতিবাহিত হল ...

বুড়োর বাগানের ডুমুর গাছে ফল এসেছে। বুড়োর আর খুশি ধরে না। বুড়ো মনের আনন্দে গাছ থেকে পেড়ে পেড়ে ফল খেল। একা খেল না। পাড়া প্রতিবেশিকেও দিল। গালীল প্রদেশের লোকে বলে বুড়োকে বলল, ডুমুরবুড়ো।
যা হোক। শোনা গেল সম্রাট হাদ্রিয়ান নাকি গালীল প্রদেশে এসেছেন । তাহলে তো সম্রাটের সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার।
ডুমুরবুড়ো ছোট একটা ঝুড়িতে ডুমুর ভরে নিল।
তারপর প্রাসাদে রওনা হল ।
সিংহদরজায় ডুমুরবুড়ো কে আটকালো সৈন্যরা ।
ডুমুরবুড়ো বলল, আমি সম্রাটের জন্য ডুমুর এনেছি।
থুরথুরে বুড়ো দেখে সৈন্যরা ডুমুরবুড়ো কে সম্রাটের কাছে নিয়ে গেল।
সম্রাট ডুমুরবুড়ো কে দেখামাত্রই চিনতে পারলেন।
ডুমুরবুড়ো ঝুঁকে সম্রাটকে অভিবাদন করল। তারপর বলল, জাঁহাপনা। দশ বছর আগে আপনি এক বুড়োকে ডুমুর গাছ লাগাতে দেখেছিলেন। আপনার মনে আছে কি?
সম্রাট মাথা নাড়লেন।
তখন আপনি বলেছিলেন: প্রার্থনা করি আপনি যেন ফল খেতে পারেন। আপনি ফল খেতে পারলে আমাকে জানাবেন। আমিই সেই বৃদ্ধ ।
সম্রাট মাথা নাড়লেন।
ডুমুরবুড়ো বলল, এ বছর আমার বাগানের ডুমুর গাছে ফল ধরেছে। সে ফল আমি খেয়েছি। আপনার জন্যও কটা নিয়ে এসেছি।
সম্রাট হাদ্রিয়ান অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বুড়ো তার পরিশ্রমের ফল উপভোগ করছেন ।
সম্রাট বুড়োকে ঝুড়ি ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দিতে নির্দেশ দিলেন।
ঝুড়ি ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে ডুমুরবুড়ো চলে গেল।
রাজদরবারে পারিষদ বর্গ সম্রাটকে জিগ্যেস করল, সম্রাট, আপনি এই বুড়ো ইহুদিকে এত সম্মান দেখালেন কেন?
সম্রাট হেসে বললেন, স্বর্গ যেখানে এই বৃদ্ধকে সম্মান করে ... আমি করব না কেন?

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু ...

এক কুচুটে বুড়ি ছিল ডুমুরবুড়োর পড়শী ।
বুড়ি শুনল, ডুমুরবুড়ো ঝুড়ি ভরতি ডুমুর নিয়ে রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ানের কাছে গিয়েছিল। সম্রাট খুশি হয়ে ডুমুরবুড়োকে ঝুড়ি ভর্তি করে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছেন।
ঈর্ষায় জ্বলতে জ্বলতে বড় একটা ঝুড়িতে ডুমুর ভরল বুড়ি । তারপর স্বামীকে বলল, এখন এই ঝুড়ি নিয়ে সম্রাটের কাছে যাও। সম্রাট তোমায় স্বর্ণমুদ্রা দেবে।
লোকটা রাজবাড়ির দিকে রওনা হল।
ফটকের কাছে সৈন্যরা তাকে আটকালো।
লোকটা বলল, আমি সম্রাটের জন্য ডুমুর নিয়ে এসেছি।
সৈন্য বলল, দাঁড়াও আগে শুনে আসি।
সম্রাট সব শুনলেন। তারপর গম্ভীরকন্ঠে বললেন, লোকটাকে সিংহদরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখ । যারা ওখান দিয়ে যাবে তারা যেন লোকটার দিকে ডুমুর ছুঁড়ে মারে।
লোকটা অত্যন্ত ক্ষুব্দ হয়ে ঘরে ফিরে গেল। তার চোখমুখ ফুলে আছে।
বুড়ি সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আহা বেচারা। মুখচোখের বারোটা বেজে গেছে। যাক, এখন এসব ভুলে যাও । তোমার কপাল ভালো যে তুমি নাড়কেল নিয়ে যাওনি। তাহলে বুঝতে!


5. দরবেশ ও মধুর পাত্র

প্রাচীন ফিলিস্তিন রাজ্যে একজন লোক বাস করত। তার স্ত্রী গর্ভবতী হল। লোকটি তখন আনন্দে ডগমগ হয়ে তার স্ত্রীকে বলল, দেখ, তোমার পুত্রসন্তান হবে। ছেলের মুখ দেখে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাব। আমি আমার ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলব। ভালো ভাবে মানুষ করব। আমার মৃত্যুর পরও আমার ছেলে আমার নাম রাখবে। আমার বংশের মানসম্মান বৃদ্ধি করবে।
লোকটার স্ত্রী খানিকটা ঝাঁঝ দেখিয়ে বলল, শোন, অত বকবক করো না।
কেন? লোকটা অবাক হল।
লোকটার স্ত্রী বলল, ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা তুমি জান না। তুমি কি ভাবে জানলে যে জন্মের সময় কোনওরকম ঝামেলা হবে না? আর ছেলেই যে হবে তাই-বা তুমি কি করে জানলে। কি করে জানলে সেই ছেলে বেঁচে থাকবে, ছেলের স্বাস্থ্য ভালো হবে।
লোকটা চুপ করে থাকে। স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না।
লোকটার স্ত্রী বলল, এসব বলে অত অহংকার করো না। সব ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দাও। তিনিই আমাদের ভাগ্যকে নির্ধারিত করে দেন।
লোকটা চুপ করে থাকে। তার স্ত্রী জিগ্যেস করে, তুমি কি সেই দরবেশের কাহিনী জান?
কোন্ দরবেশ? লোকটাকে কৌতূহলী মনে হল।
বলছি। রাজা দাউদের আমলের ঘটনা। এক দরবেশ কে রাজা দাউদ প্রতিদিন দুটি রুটি ও খানিকটা মধু দিতেন। দরবেশ রুটি খেত এবং একটা পাত্রে মধু জমিয়ে রাখত। সেই মধুর পাত্রটি দরবেশ মাথায় বহন করত। আমি যখনকার কথা বলছি সে সময়ে মধুর দাম ছিল চড়া। দরবেশ একদিন দেখল যে মধুর পাত্রটি প্রায় ভরে উঠেছে। দরবেশ মনে মনে ভাবল: মধুর দাম এখন চড়া। পাত্রটা ভরে উঠলেই বাজারে গিয়ে মধু বিক্রি করে দেব। এক পাত্র মধুর বিনিময়ে কি একটি স্বর্ণখন্ড পাব না? ঠিকই পাব। আর তাতে দশটি ভেড়ার দাম ঠিকই হয়ে যাবে। ওগুলির বাচ্চাকাচ্চা হবে । সেই হিসেবে এক বছরে অন্তত কুড়িটি ভেড়া তো পাবই। এভাবে ভেড়ার সংখ্যা বাড়তে থাকবে। তাহলে চার বছরে পাব চার’ শ ভেড়া! ওগুলি বেচে কিনব জমি, বলদ আর গরু । গরুর বাছুর হবে। বলদ দিয়ে জমি চাষ করব। ওহো, গরু থেকে তো দুধও পাব। পাঁচ বছরে আমার গোসম্পদ বাড়বে। লোকে আমাকে দেখিয়ে বলবে, ঐ লোকটা প্রচুর ধনসম্পদের মালিক । ঝকঝকে সুন্দর একটা বাড়ি বানাব। অনেকগুলি দাসদাসী কিনব। তারপর বিয়ে করব অভিজাত বংশে। আমার বউ গর্ভবতী হবে ... ফুটফুটে নাদুসনুদুস ছেলে হবে। তার জন্মের সময়ে আকাশে সৌভাগ্যশালী তারকা জ্বলজ্বল করবে। আমার পুত্রসন্তান হবে সুখি ও আর্শীবাদ পুষ্ট। আমার মৃত্যুর পরও আমার সুনাম বহন করবে ... আর যদি ... আর যদি আমার ছেলে আমার কথা না শোনে তো এই লাঠি দিয়ে ওকে আমি পেটাব । বলে দরবেশ লাঠি তুলে। তুলতেই লাঠির আঘাতে মাথার ওপর রাখা মধুর পাত্রটি ভেঙে যায় ...
লোকটার স্ত্রী বলল, তোমাকে শিক্ষা দিতেই আমি এই গল্পটা বললাম । যা নিশ্চিত নয় সে সম্পর্কে কথা বলা মূর্খের কাজ। একবার রাজা সলোমনের সেই কথাটা মনে করে দেখ।
কোন কথা? লোকটা জিগ্যেস করে।
কাল কি হবে তা যখন তুমি জান না ... তখন নিজেকে নিয়ে অত গর্ব করো না।

6. লম্বা লেজআলা পাখি

এক গভীর জঙ্গলে বাস করে একটি ‘কালেজ পাখি’। দেখতে অনেকটা ময়ূরের মতোই। এই পাখিটি ছিল মেয়ে পাখি। তার খুবই সাধ তার ছানারা দেখতে হবে ভীষণ মিষ্টি, আর বড় হয়ে ভারী সুন্দর পাখি হয়ে উঠবে। অনেক খুঁজে ডিম পাড়ার মত একটা গোপন আস্তানা সে বের করল, কেউ যাতে এই জায়গার খোঁজ না পায়, সে জন্য সে সবকিছু গোপনও রাখল। যখন সময় হলো সে ডিম পাড়ল, সুন্দর করে নীড় রচনা করল আর ডিমে তা দিলো। সত্যি সত্যি ক’দিন পর ডিমের খোসা ভেঙে বেরিয়ে এলো ছোট্ট ছোট্ট পাখির ছানা। মিষ্টি ছানা দেখে পাখি মনে মনে বেশ গর্ব অনুভব করল।
শেয়াল, চালাক বলে চালাক, সে কেমন করে যেন টের পেয়ে গেল এই গোপন আস্তানার কথা। শেয়ালটি ছানা আর পাখিটিকে খাবে বলে ঠিক করল। এদিকে পাখি টের পেয়ে গেছে শেয়ালের মতলব! নিজেকে আর নিজের আদরের ছানাগুলোকে বাঁচানোর জন্য সে এক ফন্দি আঁটল। শেয়াল কাছে আসতেই হাত কচলে, কাঁচুমাচু চেহারাটি বানিয়ে বিনয়ী ঢঙে বলল, ‘আসুন  মন্ত্রী মশাই, এই বনের মাননীয় মন্ত্রী, আসতে আজ্ঞা হোক, বসতে আজ্ঞা হোক। সবাই জানে এই বনে  আপনিই হলেন  সবচেয়ে চৌকস আর চালাক-চতুর প্রাণী। আপনি তো ভাল করেই জানেন, এসব ছানাপোনার গা-গতরে মাংস বলে কিচ্ছু নেই। কয়েক সপ্তাহ যাক, আমি ওদের একটু দানাপানি খাওয়াই, তবেই না পাখির মাংস খেয়ে আপনি মজা পাবেন। গা-গতরে মাংস-চর্বি হোক, ততদিন পর্যন্ত মন্ত্রীমশাই একটু ধৈর্য ধরতেই হবে যে’।
অহংকারী শেয়াল তোষামোদে গলে গেল, তাছাড়া জীবনে এই প্রথম ‘মন্ত্রীমশাই’ সম্বোধন শুনে সে তো খুশিতে বাগ-বাগ। সে নিজেও চট করে ভেবে দেখল, সত্যি, নরম হাড্ডিসর্বস্ব এই ছানাপোনার তো আর একটা গ্রাসও হবে না। কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করাই বরং ভাল। সে পাখিটিকে বলল, ‘তুমি আমাকে এই বনের মন্ত্রী বলেছো, আমি বড় খুশি হয়েছি। কিন্তু তুমি একা মন্ত্রী বললে আমার কী লাভ?’
চালাক পাখি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘সে কি কথা জনাব! আমার এত সুন্দর কণ্ঠস্বর, আমি গোটা বনে চিৎকার করে বলে বেড়াব যে আপনি, আপনিই হলেন এই বনের একমাত্র মন্ত্রী। এরপর বনের সবাই আপনাকে মন্ত্রীমশাই বলে ডাকবে, দেখবেন। খুশিতে ডগমগ শেয়াল এই প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু ফেরার সময় সাবধান করে দিলো, যদি বনের সবাই তাকে মন্ত্রীমশাই বলে না ডাকে, তবে এসেই সে ছানাগুলো খেয়ে ফেলবে।
পাখিটি তড়িঘড়ি করে একেক ছানাকে একেক জায়গায় রেখে এলো। সে ঠিকই জানত, ধূর্ত শেয়াল ঠিকই ফিরে আসবে, এসেই তার আদরের ছানাগুলোকে খেয়ে ফেলবে। তার অত সুন্দর স্বরই বা রইল কোথায়? কোথায় বা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ঘোষণা দেয়া?
প্রথম যেখানে তার সঙ্গে শেয়ালের দেখা হয়েছিল, সেখানে বড় এক গর্ত খুঁড়ে, তার ওপর শুকনো লতাপাতা দিয়ে, কচি ঘাসের চাপড়া দিয়ে গর্তটা ঢেকে রাখল।
এদিকে খবর কিন্তু মোটেও ভাল নয়। শেয়াল বুক ফুলিয়ে রোয়াব দেখিয়ে হাঁটছে, কিন্তু বনের একটি প্রাণীও তাকে মন্ত্রীমশাই বলে ডাকছে না। না ডাকুক, একটু তাজিমের সঙ্গে তো কথা বলতে পারে, তা-ও না। রেগে-মেগে সে তো এলো সেই গর্তের কাছে। পাখিটি এমনভাবে বসে আছে যেন ছানাদের উম দিচ্ছে। শেয়াল এসেই হম্বিতম্বি শুরু করে দিলো, কেন সে কথা দিয়ে কথা রাখেনি, কেন সে ঘোষণাটি দিয়ে দেয়নি। পাখিটি সোজাসাপ্টা বলে দিল, ‘তুমি তো আস্ত বুদ্ধু। কার এমন গরজ পড়েছে যে, তোমাকে মন্ত্রীমশাই বলে তোয়াজ করবে’?
পাখির অপ্রত্যাশিত সাহস দেখে শেয়াল তো অবাক। রেগে লাল হয়ে সে যেই না লাফ দিয়ে ধরতে গেল পাখি, পাখি কি আর থাকে? অমনি সে গেল উড়ে, আর উপরের লতাপাতা ঘাস-বিচালি সমেত শেয়াল পড়ে গেল গর্তে। পাখি দেখে আর হাসে। পাখির হাসি দেখে শেয়াল আরও রেগে গিয়ে উপরে উঠতে যায়, গর্তটা গভীর বলেই বারবারই গর্তে পড়ে যায়। কোন মতে গর্তের মুখ ছুঁতে পারলেও শরীরের ভারে আবার পড়ে যায়। পাখি কিন্তু হেসেই যাচ্ছে, শুধুই হিঃ হিঃ হিঃ, শুধু হোঃ হোঃ হোঃ। শেয়াল আরও চটে যায়। আর লাফ-ঝাঁপ দেয়, কিন্তু ঘুরে-ফিরে সেই গর্তে।
এদিকে হাসতে-হাসতে হাসতে-হাসতে প্রথমে পাখির চোখে পানি এসে গেল। পানি পড়ছে তো পড়ছেই, পানি পড়তে-পড়তে পড়তে-পড়তে পাখির চোখ একেবারে লাল টুকটুকে হয়ে গেল।
এখন এই কালেজ পাখিটিকে যদি তোমাদের দেখার সুযোগ কখনো হয়, দেখবে, তার দুটি চোখই জবা ফুলের মত টকটকে রাঙা।


এরকম আরো ভালো গল্প পেতে আমাদের কে ফলো  করুন